লেস্টার সিটির রুপকথার অন্যতম নায়ক | One of the legends of Leicester City

রিয়াদ মাহরেজঃ লেস্টার সিটির রুপকথার জন্ম দেওয়ার অন্যতম নায়ক অথবা বাবার অনুপ্রেরণায় মুগ্ধ হয়ে ফুটবলার হয়ে উঠার উপাখ্যান!
লেস্টার সিটির রুপকথার অন্যতম নায়ক


,
,
সময়টা তখন ডিসেম্বরের ৫ তারিখ। ২০১৫-১৬ সিজনে সোয়ানসি সিটির ঘরের মাঠে ০-৩ গোলে বিধ্বস্ত করেন ২০১৪-১৫ সিজনে প্রিমিয়ার লীগে প্রমোট পাওয়া দল লেস্টার সিটি এবং ঐ তিনটি গোল এসেছিল একজনের কাছ থেকেই! যারফলে দেখা পেয়ে গেলেন প্রিমিয়ার লীগে নিজের প্রথম হ্যাট্টিক! শুধুই কি হ্যাট্টিক? নাহ! বরং হ্যাট্টিকের পাশাপাশি ছুঁয়ে ফেললেন নতুন একটি মাইলফলক, যা কিনা প্রথম আলজেরিয়ান খেলোয়াড় হিসেবে প্রিমিয়ার লীগে হ্যাট্টিক করার কৃতিত্ব! এতক্ষণ ধরে যার কথা বলছি তিনি হচ্ছেন 'রিয়াদ মাহরেজ'।
১৯৯১ সালের ২১ ই ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের ছোট্ট শহর সার্সেলেসে জন্মগ্রহণ করেন রিয়াদ মাহরেজ। রিয়াদ মাহরেজ সাধারনত একজন রাইট উইঙ্গার হিসেবে পরিচিত। তবে, তিনি একজন ভার্সেটাইল খেলোয়াড়, যিনি আক্রমণ ভাগের যেকোন ফ্ল্যাঙ্কে খেলতে পারেন। খেলার মাঠে তার ক্রিয়েটিভিটি, ট্যাকটিক্যালি গুণ, গতি, ড্রিবলিং ইত্যাদি দক্ষতার কারনেই তাকে চেনার জন্য যথেষ্ট!
রিয়াদ মাহরেজের বাবার নাম ছিল আহমেদ মাহরেজ এবং মায়ের নাম হালিমা মাহরেজ। একজন পেশাদার ফুটবলার হওয়ার পিছনে রিয়াদ মাহরেজের গল্পটা মোটেও সুখকর ছিলোনা। রিয়াদ মাহরেজের পরিবারটি ধনীও ছিলোনা আবার গরীবও ছিলোনা। তিনি একটি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসেন। তার বাবা ছিলেন গনিতে প্রতিভাধর একজন ছাত্র, পাশাপাশি ফুটবলারও। ভদ্রলোক খেলেছিলেন আলজেরিয়া এবং ফ্রান্সের ছোট ছোট দলের হয়ে পেশাদার ফুটবল! অন্যদিকে হালিমা মাহরেজ বাইরে কাজ করতেন এবং কাজ শেষে বাড়িতে এসে আবার পরিবারে'র সব কাজ সামলাতেন।
রিয়াদ মাহরেজের বেড়ে উঠা ফ্রান্সের ছোট্ট শহর সার্সলেসে হলেও তার বাবা মরোক্কান সীমান্তের নিকটবর্তী পশ্চিম আলজেরিয়ার পল্লীতে এল খামেমির ছোট্ট গ্রামে বেড়ে উঠেন। ছেলে বেলাতেই ছুটির সময়ে মাহরেজ তার বাবার সাথে বেড়াতে যেতেন আলজেরিয়াতে। বাবার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েই একজন ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছাটা মনের মধ্যে গেঁথে নেন রিয়াদ মাহরেজ। আহমেদ মাহরেজ বিশ্বাস করতেন তার ছেলে ফ্রান্সের না বরং আলজেরিয়ার হয়েই ফুটবল খেলবেন।
মাত্র ১৫ বছর বয়সেই বাবাকে হারান তিনি! তারপর শুরু হয় আরো কঠিন সময়। তাছাড়া একজন পেশাদার ফুটবলার হওয়ার পিছনে মাহরেজের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার শারীরিক দুর্বলতা। তার দেহের গড়ন মোটেও ভালো ছিলনা, ওজন ছিল তার বয়সের তুলনায় অনেক কম! তবে তাকে যে, তার বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবেই! বেঁচে থাকতে বাবার জন্য কিছুই করতে পারেননি তিনি! বাবাকে হারানোর পর ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটা শিরায় শিরায় মিশে যায় তার। শারীরিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও মাকে কথা দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন "তুমি দেখো মা একদিন আমি পেশাদার ফুটবলার হবোই, তুমি দেখো"!
বাবার স্বপ্ন পূরণ করার লক্ষেই ২০০৯ সালে রিয়াদ মাহরেজ যোগদেন কুইমপারে। সেখানে তিনি ছিলেন মাত্র ১ টি সিজন। খেলেছিলেন ২২ টি ম্যাচ ও করেছিলেন মাত্র ২ টি গোল। কুইম্পারের হয়ে খেলার সময় তিনি ম্যাথিয়াস পগবার সাথেই থাকতেন বেশী।
তারপর ২০১০ সালে তিনি চলে যান লে হাভ্রেতে। সেখানে তিনি কাটিয়েছেন ৪ টি বছর। ঐ সময় তার ফুটবল প্রতিভা দেখে পিএসজি, মার্শেই থেকে তাকে কেনার জন্য প্রস্তাব দেন কিন্তু ফ্রান্সের ক্লাবগুলির রক্ষণাত্মক ফুটবলে বিরক্ত হয়ে তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করে দেন রিয়াদ মাহরেজ।
মাহরেজ যখন লে হাভ্রের হয়ে খেলেছিলেন, তখন চ্যাম্পিয়নশিপের ক্লাব লেস্টার সিটির স্কাউট দলের সদস্য স্টিভ ওয়ালশ পর্যবেক্ষণ করছিলেন মাহরেজের সতীর্থ রায়ান মেন্ডেসকে। অথচ স্টিভ ওয়ালশ মুগ্ধ হয়েছিলেন মাহরেজেই! তারপর ২০১৪ সালের ১১ ই জানুয়ারি লেস্টার সিটিতে সাড়ে ৩ বছরের চুক্তিতে সাক্ষর করেন তিনি। লেস্টারের হয়ে ডেব্যু করেন ২৫ ই জানুয়ারি বিকল্প খেলোয়াড় হিসেবে। লেস্টারের হয়ে চারবারের মত বিকল্প খেলোয়াড় হিসেবে নেমে নটিংহাম ফরেস্টের বিপক্ষে ম্যাচের ৮২ তম মিনিটে তার গোলের কারনেই সমতায় ফিরে লেস্টার। তখন লেস্টারের কোচ নাইজেল পিয়ারসন মনে করেন মাহরেজ এখন থেকে খেলার জন্য ফিট। তারপর থেকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
চ্যাম্পিয়নশিপে লেস্টার সিটি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কারনে তার দল প্রিমিয়ার লীগে প্রমোট হয়। ২০১৪ সালের ১৬ ই আগস্ট প্রিমিয়ার লীগে ডেব্যু করেন রিয়াদ মাহরেজ। নতুন পরিবেশে মানাতে একটু কষ্ট হয় সবারই তেমনি মাহরেজও ব্যাতিক্রম ছিলেননা। ঐ সিজনে ৩০ ম্যাচে ৪ গোল ৩ এসিস্ট নিয়ে মাত্র ৭ গোলে অবদান রাখেন মাহরেজ। টেবিলের ১৪ নম্বরে থেকে সিজন শেষ করে লেস্টার।
এই লেস্টারে এসেই পাল্টে যায় মাহরেজের ক্যারিয়ারের গতিপথ এবং সেটা বলতে গেলে ২০১৫-১৬ সিজনে। ঐ সময়ে ফুটবল বিশ্ব চিনলো নতুন এক রিয়াদ মাহরেজকে। তাছাড়া লেস্টার সিটির রুপকথার জন্ম দেওয়ার অন্যতম কারিগর ছিলেন এই রিয়াদ মাহরেজই। ঐ সিজনে তিনি লেস্টারের হয়ে গোল করেন ১৭ টি, যা ভার্ডির পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং এসিস্ট করেন ১১ টি যা লেস্টারের হয়ে সর্বোচ্চ! ১৭ গোল ও ১১ এসিস্ট নিয়ে প্রিমিয়ার লীগে টোটাল ২৮ গোলে অবদান রেখে লেস্টারকে লীগ জিতাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি।
পুরো সিজন জুড়ে রিয়াদ মাহরেজের চমকপ্রদ পারফর্মের কারনে রেকর্ড করেন প্রথম আলজেরিয়ান হিসেবে প্রিমায়ার লীগে বর্ষ সেরা ফুটবলারের খেতাব এবং প্রথম আলজেরিয়ান হিসেবে প্রিমিয়ার লীগে হ্যাট্টিক করার কৃতিত্ব। তাছাড়া তিনিই প্রথম আলজেরিয়ান খেলোয়াড়, যিনি প্রিমিয়ার লীগ জয়ের মেডেল পড়েছেন।
ফ্রেঞ্চ ক্লাব লে হাভ্রে থেকে যখন লেস্টার সিটিতে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন মাহরেজ, তখন অনেক মানুষ বলেছিল শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার কারনে তিনি ইংলিশ ক্লাবে সফল হতে পারবেননা। মাহরেজ নিজেও ভেবেছিল ইংল্যান্ডে কখনো খেলাই হবেনা তার। অথচ এই খেলোয়াড়টি ইংল্যান্ডে শুধু খেলেননি বরং হয়েছিলেন ইংল্যান্ডের বর্ষসেরা প্লেয়ারও!
শুধু ক্লাবেই নয় বরং জাতীয় দলের হয়েও তিনি তার দলকে ট্রফি জেতাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আফ্রিকা নেশনস কাপের সেমিফাইনাল ম্যাচের অতিরিক্ত ৯০+৫ মিনিটের সময় বক্সের বাইরে থেকে বাঁ পায়ে মনঃমুগ্ধকর ফ্রিকিক গোলের সুবাদে আলজেরিয়াকে ফাইনালে পৌছায় রিয়াদ মাহরেজ!
১৯৯০ সালের পর আলজেরিয়া আফ্রিকা নেশনস কাপ জিতে এবং সেটা রিয়াদ মাহরেজের নেতৃত্বেই। ঐ আসরে তিনি দলের হয়ে করেছিলেন ৩ টি গোল, যা যৌথভাবে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ!
ফ্রান্সের হয়ে অনেক কিছু জেতার সম্ভাবনা আছে জেনেও শুধুমাত্র বাবার স্বপ্ন পূরণ করার জন্যেই আলজেরিয়ার হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নেন রিয়াদ মাহরেজ। আলজেরিয়ার হয়ে ট্রফি জেতা বা আলজেরিয়ার হয়ে গোল করার পর উল্লাস করা কিংবা ক্লাব ফুটবলে আলজেরিয়া নামটাকে ফুটবল বিশ্বে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করা এই সবকিছুই হয়তো ওপর থেকেই দেখছেন তার বাবা আহমেদ মাহরেজ। আর হয়তো বলছেন "ওয়েল ডান মাইসান"।
,
Author

ask

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

Previous Post Next Post