শুভ জন্মদিন জেরার্ড পিকে | Happy Birthday Gerard Pique.

আর্জেন্টিনা/ব্রাজিলে ফুটবল খেলাকে যদি ধর্ম সমতুল্য ধরা হয় তবে স্পেনে ফুটবলকে গৌণ শিক্ষা সমতুল্য ধরা উচিত। আর্জেন্টিনা/ব্রাজিলে মতো এতোটা না হলেও স্পেনেও ফুটবল খেলা আয়ত্ত করাকে মৌলিক চাহিদা হিসাবে নিঃসংকোচে ধরে নেয়া যায়!

জেরার্ড পিকে


স্পেনের ফুটবলের ইতিহাস বেশ পুরনো, বেশ প্রসিদ্ধ। স্প্যানিশ ক্লাব ফুটবল সূচনালগ্ন থেকেই বিশ্বের অন্যতম সেরা লীগ, সবচেয়ে সফল, প্রতাপশালী ক্লাবগুলোর প্রথম দিকের ২ ক্লাবই স্পেনের - রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সালোনা। এদের সাফল্যের পাল্লা ভারীর উপরে ভারী। ক্লাব ফুটবলে স্প্যানিশ ক্লাবগুলোর আধিপথ্য সূচনালগ্ন থেকেই। আন্তর্জাতিক ফুটবলে স্পেনের সোনালি সময় ২০০৮-১২। এই সময়ে ২০১০ এ নিজেদের একমাত্র বিশ্বকাপ জেতে স্পেন, ২০০৮ ও ২০১২ তে পরপর দুবার ইউরো জেতে স্পেন। ঘরোয়া ক্লাব, বিদেশী ক্লাবে খেলা ইয়াং স্প্যানিয়ার্ডদের কল্যানে এ সফলতা লাভ করে স্পেন।
স্পেনের ক্লাব ফুটবল নিয়ে কথা বললে দুটি ক্লাবের নাম সবার প্রথমে আসবে ; ভুল বললাম ক্লাব ফুটবলের কথা বললে এদের নামই প্রথমে আসার কথা - রিয়াল ও বার্সা। দুটো ক্লাবই পাওয়ারহাউজ। লাস্ট ১০ বছরে ৬ বার উচল চ্যাম্পিয়ন এই দুই স্প্যানিশ জায়ান্ট, লাস্ট ১০ লীগ টাইটেলের ৯টা রিয়াল-বার্সা।
ন্যাশনাল ও ক্লাব লেভেলে স্পেন ও বার্সার উত্তরোত্তর সাফল্যে যে কয়জনের সবচেয়ে বেশি দ্বৈত ইম্প্যাক্ট রয়েছে তাদের মধ্যে জেরার্ড পিকের প্রথম সারিতে অবস্থান। স্পেনে ইন্টারন্যাশনাল সাক্সেস ও বার্সেলোনার হিস্টোরিক রানে ডিফেন্স লাইনের অগ্রজ সৈনিক ছিলেন/আছেন জেরার্ড পিকে।
স্পেনের অন্যান্য ফুটবল স্টারের মতো জেরার্ড পিকে ক্যারিয়ার শুরু করেন পাঠ্যপুস্তক সহ স্পোর্টস শিক্ষা সহকারে। স্পেনে অল্পবয়স থেকে শুধু খেলতে আগ্রহী করে তুলা হয়না বরং একাডেমী এবং প্রফেশনাল কোচেরা শিশুদের গাইড করেন স্পোর্টস শিক্ষাকে প্রফেশনাল চোখে দেখতে। ফুটবল খেলাকে ঘূর্ণাক্ষরেও আউটডোর এক্টিভিটি বলে ধরা হয়না স্পেনে।
স্পেনের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ফুটবল একাডেমীর অবস্থান বার্সালোনায়, নাম- লা মাসিয়া। ইনিয়েস্তা, জাভি, ফ্যাব্রেগাস, পুয়োল, বুস্কেটস এদের ফুটবলের হাতেখড়ি হয় লা মাসিয়ার হাত ধরে। তর্কসাপেক্ষে গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম আর্জেন্টাইম লিওনেল মেসিও ইয়ুথ প্লেয়ার হিসাবে লা মাসিয়া একাডেমীতে যোগ দেন ; মেসির আজকের মেসি হওয়া ও লা মাসিয়ার হাত ধরে। কাতালান জেরার্ড পিকের ফুটবলে হাতে খড়িও লা মাসিয়ার হাত ধরে, এখানেই বেড়ে উঠা।
ফুটবল একাডেমীর বিশেষত্ব হলো একাডেমীতে প্লেয়ারদের শুধু ফিজিক্যালি ও মেন্টালও পারফর্ম করার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়না, এখানে প্লেয়ারদের টিমের প্লেয়িং স্টাইল, ফিলোসফি আত্মস্থ করানো হয়। এতে প্লেয়ারদের মধ্যে আধ্যাত্নিক বন্ডিং, বুঝাপড়া ক্রিয়েট হয় ; এই বন্ডিং, বুঝাপড়া দিয়ে ক্লাব, ন্যাশনাল লেভেলে দু টিমই লাভবান হয়। প্লেয়ারদের মধ্যে দারুণ বুঝাপড়া কি পরিমান ফলদায়ক স্পেন, বার্সা, রিয়ালকে দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে! আর এসবে লা মাসিয়া একাডেমী বাকি সব একাডেমীর চেয়ে এক কাঠি সরেশ!
লা মাসিয়াতে ফুটবলের হাতেখড়ি হওয়া পিকে ১৭ বছর বয়সে লা মাসিয়া ছেড়ে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দেন। লা মাসিয়া ছেড়ে ম্যানচেস্টার একাডেমীতে কেন যোগ দিলেন পিকে তার রহস্যভেদ করা এখনও সম্ভবপর হয়ে উঠেনি! কেউ কারন জানেনা, পিকে খোলশা করলে কোনোদিন হয়তো জানা গেলে যেতে পারে!
১৭ বছর বয়সে ইউনাইটেড একাডেমীতে যোগ দেওয়া পিকের সিনিয়র টিমে অভিষেক হয় তার ৪ বছর পর আইকনিক ম্যানেজার স্যার আলেক্স ফার্গুসন এর অধীনে। আলেক্স ফার্গুসন তার উপর ভরসা করে উঠতে পারেননি বুঝতে সক্ষম হন জেরার্ড পিকে। ম্যান ইউনাইটেড থাকাকালীন সময়ে নিজের চাহিদা মতো তো দূর থাকে চাহিদার কাছাকাছিও গেইম টাইম পাননি পিকে। অসন্তুষ্ট পিকে বার্সাতে ফিরে আসার তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন, ফার্গুসন তার দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। ফার্গুসনের সহযোগিতায় বার্সা নিজের ঘরে ফিরে আসেন পিকে। (ধন্যবাদ স্যার ফার্গুসন)।
বার্সাতে ফিরেই, পিকে বার্সার সেন্টার ব্যাক পজিশনে প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠতে শুরু করেন। ঐ সময় বার্সা নজিরবিহীন সাফল্য লাভ করতে থাকে, দৃষ্টিনন্দন, নান্দনিক ফুটবল খেলতে থাকে। গার্দিওয়ালার অধীনে বার্সার প্লেয়িং স্টাইল, খেলার রেজাল্ট স্পোর্টিং ওয়াল্ড এ আলোড়নের সৃষ্টি করে। টিমে পিকে অনস্বীকার্য হয়ে উঠতে শুরু করেন, গার্দিওয়ালার প্লেয়িং স্টাইলে সিবিদের যে কোয়ালিটিগুলো থাকতে হয় স্পীড বাদে তার সবই ছিল পিকের।
স্পেন ও বার্সার ডমিনেন্ট সাইডকে ফুটবল বিশ্ব তাদের এটাকিং তেজস্বী মনোভাব, তাদের অফেন্সিভ এপ্রোচের জন্য সবচেয়ে বেশি মনে রাখবে। এক্ষেত্রে স্পেন বা বার্সার ডিফেন্ডাররা বেশ আন্ডাররেটেড থেকেছেন। তবে স্পেন, বার্সার নান্দনিক এটাকিং এপ্রোচ এর পিছনে বিশাল অবদান রয়েছে ডিফেন্স লাইনের। পিকে ছিলেন তাদের বিশ্বস্ত একজন রক্ষী। স্পেন, বার্সার এটাকিং সাইড জানত তাদের পিছনে পিকে এবং কোয়ালিটিফুল ডিফেন্ডাররা আছে যারা যেকোনো কাউন্টার এটাক রুখতে সক্ষম ; তাই এটাকার, মিডফিল্ডররা এত ফ্লুলেসলি এটাক করতে পারত। পিক ফর্মের পিকে ছিলেন তর্কসাপেক্ষে তার সময়ের সেরা ডিফেন্ডার তার কোয়ালিটির জন্য।
১.৯৪ মিটারের ফিজিক্যালি স্ট্রং পিকে এয়ারে বার্সার সবচেয়ে বিশ্বস্ত রক্ষী, স্পেনেরও। এরিয়ালে একজন বিস্ট, ডুয়েলস এও। এরিয়াল-ডুয়েলসে বার্সার লাস্ট ১০ বছরের সেরা সিবি। হাইটের কারণে সেট পিসে অপনেন্টের জন্য একজন থ্রেট পিকে। পাসিং হচ্ছে উনার সবচেয়ে শক্তির জায়গা, বার্সা/স্পেনের সিবি হওয়ার পূর্বশর্ত হল বল প্লেয়িং এভিলিটি ভালো হতে হবে; গার্দিওয়ালার টিমে তো কোনো কথাই নেই। এই ডিমান্ড শুরু থেকে বেশ ভালোভাবেই পূরণ করেছেন পিকে। ইন্টারসেপশন, গেম রিডিং এভিলিটি, কভারিং এভিলিটি বেশ ভালো উনার। ট্যাকলিং এ দুর্বলতা ছিল/আছে তবে সেটা পূরণ করে দিয়েছেন গেম রিডিং এভিলিটি ও অন স্পটে সবসময় হাজির থেকে। ডিফেন্স অর্গানাইজিং এর পাশাপাশি টিম অর্গানাইজিং এ বেশ ভালো ভূমিকা রাখেন/রাখতেন উনি। লা মাসিয়া ও গ্রেট আলোক্স ফার্গুসনের অধীনে নিজেকে ছাঁচিয়ে নিয়েছিলেন জেরার্ড পিকে ; যা তাকে একজন ট্রু স্পেশাল ডিফেন্ডারে পরিণত করেছিল।
অন দা পিচে পিকের সাক্সেস দেখা ফ্যান হিসাবে যতটা সহজ ছিল; পিকে বা অন্যান্য বার্সা/রিয়াল প্লেয়ারের জন্য ন্যাশনাল লেভেলে সাক্সেস পাওয়া ততটা চ্যালেঞ্জিং হতে পারতো। ফুটবল পাগল স্পেন দুই ভাগে সবসময় বিভক্ত থাকে। ন্যাশনাল টিমে অবশ্যম্ভবী বিভাজন ছিল, পাবলিক সাপোর্টে পিকের বার্সা ও তাদের আর্চ রাইভাল রিয়ালের মধ্যে বিশাল বিভাজন ছিল। এল ক্লাসিকোতে একে অপরের মুখোমুখি হওয়া ফুটবল বিশ্বের দৃষ্টি একদিকে কেড়ে নিত, আলোড়ন সৃষ্ট করত, সমর্থকদের তীব্র প্রত্যাশা,আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি দুই টিমের প্লেয়ারদের মধ্যেও ছড়িয়ে যেত।
অবশ্য ক্লাব ফুটবলে যতই বিদ্বেষ থাককু ন্যাশনালে সবাই এক মন এক প্রাণ হয়ে যেত। রিয়াল-বার্সার প্লেয়াররা নিজেদের রাইভালারি ভুলে মাঠে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে সদা সর্বদা প্রস্তুত থাকত। এক্ষেত্রে জাতীয় দলে একতা বজায় রাখতে যে কয়জন প্লেয়ার অগ্রণী ভূমিকা রাখতো জেরার্ড পিকে তাদের মধ্যে অন্যতম। পিকে স্প্যানিশ ন্যাশনাল টিমে খেলা রিয়াল, বার্সার প্লেয়ারদের নিয়ে স্পেশাল হোয়াটস এপ গ্রুপ ক্রিয়েট করতেন।
প্লেয়ারস ট্রিবিউনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পিকে বলেনঃ "গ্রুপের ক্রিয়েটর আমিই ছিলাম, এই গ্রুপ ক্রিয়েট করার উদ্দেশ্য ছিল ন্যাশনাল টিমে সবাই একতাবদ্ধ থাকা। গ্রুপে আমরা এক অপরে বার্সা রিয়াল নিয়ে অনেক কথাবার্তা বলতাম। ঐ সময়ের ফিলিংসটা বেস্ট ছিলো। আমরা ছোট শিশুর মতো ছিলাম গ্রুপে, মজা মাস্তিতে মেতে থাকতাম। আমি (পিকে) তাদের সাথে মজা করতে পারতাম কেননা তারা স্প্যানিশ ন্যাশনাল টিমের ভাই ছিল। আমরা একে অপরের ক্লাবকে ঘৃণা করতে পারি কিন্তু আমরা একই দেশের হয়ে খেলতাম, একই স্বপ্ন নিয়ে খেলতাম ; এটার জন্য আমি সবসময় গর্ববোধ করতাম। অল্প বয়সে ৯৪ বিশ্বকাপে লুইস এনরিকেকে যখন আমি রক্তাক্ত অবস্থায় স্প্যানিশ জার্সি পড়িহিত অবস্থায় দেখি, তখন থেকে আমি স্পেন ন্যাশনাল টিমের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখি।"
ক্লাব, জাতীয় দলের সাফল্যের কেন্দ্রে অবস্থান করা পিকে তার যথাযথ মূল্যায়ন অনেক সময়ই পাননি; রাইভালারি একটা বড় ফ্যাক্ট।
পিকে ক্লাব বার্সালোনা ও স্পেনের সাফল্যের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি ছিলেন। অন দা ফিল্ড, অফ দা ফিল্ড যতটা হাইপ এটেনশান পেয়েছেন তার প্রতিটা বিন্দু কণা পিকের প্রাপ্য। পিকে ছিলেন ঐ ইয়ং বয় যে নিজের সাধ্যের সর্বোচ্চটা শিখেছে। লা মাসিয়া, বার্সেলোনা, ম্যান ইউনাইটেড থেকে ফুটবলের সব রস যথাযথভাবে আস্বাদন করার চেষ্টা করেছে ; যা তাকে একজন বিস্ট ডিফেন্ডারে রুপান্তরিত করেছে।
পিকে হচ্ছেন ঐ স্প্যানিশ মানব যে তার শিক্ষার বেশিরভাগই রপ্ত করতে পেরেছেন!
শুভ জন্মদিন জেরার্ড পিকে ❤

তার অর্জন ঃ
১.ফিফা বিশ্বকাপ ঃ ২০১০
২.ইউরো ঃ ২০১২
৩. ইপিএল ঃ১টি
৪. লা লিগা ঃ ৮টি
৫.কোপা ডেল রে ঃ ৬টি
৬.চ্যাম্পিয়নস লিগ ঃ ৩বার্সা ১ ম্যান ইউ
৭.উয়েফা সুপার কাপ ঃ৩টি
৮.ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ ঃ ৩টি
৯.লা লিগা বেস্ট ডিফেন্ডার
এছাড়াও আরও অনেক পুরষ্কারে ভূষিত তিনি
Author

ask

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

Previous Post Next Post